ছোট গল্পঃ 'ময়ূরাক্ষী আমারও' - হাসান পিয়াস

Become A Blogger. Publish Your Post Click Here!

X




Bottom Article Ad

ছোট গল্পঃ 'ময়ূরাক্ষী আমারও' - হাসান পিয়াস

ময়ূরাক্ষী আমারও

             - হাসান পিয়াস

ময়ূরাক্ষী আমারও  হাসান পিয়াস

১.

ক'দিন আগে নিজের হাতে বানানো বেশ মোটাসোটা সাইজের ভারী চেয়ারটা, ইমন তার বাবার রুম থেকে নিজের রুমে নেয়ার চেষ্টা করছে। খুব ধীরেধীরে এবং অত্যন্ত সাবধানতার সাথে। খুব ধীর ভাবে চেষ্টার কারণ হলো, খুব একটা সহজ ভাবে এই চেয়ার এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নেয়া তেমন কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়। ইমন এর পক্ষে তো না-ই। তাই সে চেষ্টা করছে। পুরোপুরি নিতে পারছে না আরকি। আর অত্যন্ত সাবধানতার কারণটা হলো, ইমন চায় না তার বাবা ঘুম থেকে জেগে উঠে পড়ুক এবং তাকে এ অবস্থায় দেখে ফেলুক। এ অবস্থা বলেতে, রাত প্রায় আড়াইটা বাজছে এবং ইমন ব্লেজার, জিন্স প্যান্ট এবং শু জুতো পরে চেয়ার টানাটানি করছে। 

চেয়ার টানাটানির ফাঁকে ফাঁকে, ইমন এক-দু'বার করে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিচ্ছে।
তার বাবার রুমে সত্তর দশকের একটা বড়সড় দেয়াল ঘড়ি আছে। ঘড়িটার ভেতরের দিকটা কালো এবং কাটাগুলো গাড় সবুজ রঙের হওয়ায়, অন্ধকারে এই ঘড়ি দেখতে খুব অসুবিধে হয়। শুধুমাত্র ডিম লাইট'টার আলোয় একটু-আধটু যা দেখা যাচ্ছে। তবে ঘড়ি দেখতে হচ্ছে খুব পরিশ্রম করে। চোখের পরিশ্রম। ইমন তার চোখগুলো যথাসম্ভব বড়বড় করে, ক'টা বাজছে সেটা বোঝার চেষ্টা করলো।

কিছুটা আঁতকে উঠল সে। সর্বনাশ দুটা পয়তাল্লিশ বাজছে। আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকি। ইমন তার উপরের ঠোঁটে কামড়ে ধরলো। যথাসম্ভব শক্তি খাটিয়ে, সে তার পিঠ দিয়ে চেয়ার ঠেলতে শুরু করলো। আগের চেয়ে এবার বেশ ভালই বেগ পাওয়া যাচ্ছে। এ বুদ্ধিটা আগে মাথায় এলেই এতক্ষণে কাজটা সেড়ে ফেলা যেত। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম ঠোকাবার সাধ্য কারই-বা আছে? প্রকৃতির অনেকগুলো ধরাবাঁধা নিয়ম আছে। তারমধ্যে একটি হলো- যখন যে জিনিসটার খুব বেশি প্রয়োজন, তখন সেটা হাতে মিলবে না। যখন তার প্রয়োজন নেই, তখন তার অভাব নেই।

চেয়ার ঠেলতে ঠেলতে ইমন তার ঘরে এসে পৌঁছালো, ঠিক দুটা পঞ্চান্নতে। তিন'টা বাজতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বাকি। ইমন চেয়ারটা ড্রেসিং টেবিলের ঠিক সামনা-সামনি রাখলো। চেয়ারটা কাঁঠাল গাছের কাঠ দিয়ে বানানো। নতুন বার্ণিস চকচক করছে। দেখতে পুরাতন আমলের জমিদারদের চেয়ারের মতন।
রিডিং টেবিলে রাখা টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকাতে তাকাতে, বেশ তটস্থ ভাবে ইমন চেয়ারে বসে পড়লো।

ইমন তার ভ্রু জোড়া কুঁচকে, টেবিল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। আর মাত্র চার মিনিট বাকি। তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে, এখন সেকেন্ডের কাটা'টা আগের চেয়ে ধীরগতিতে চলছে। চার মিনিটকে তার চল্লিশ মিনিট মনে হচ্ছে।

মিনিটের কাটা যতই এগোচ্ছে, ততই ইমন এর কুঁচকানো ভ্রু জোড়া মসৃণ হয়ে আসছে। তিন'টা বাজার সাথে সাথে ইমনের ভ্রু জোড়া স্বাভাবিক হয়ে এলো। সে টেবিল ঘড়ির থেকে তার চোখ সরিয়ে, ড্রেসিং টেবিলের আয়নার উপর রাখলো।
আয়নায় তাকানো মাত্রই, ইমন মুচকি হাসলো। ডান পা তুলে, বাঁ পায়ের উপর রাখলো। হাত বাড়িয়ে, টেবিল থেকে একটা কলম নিলো। খুব নাটকীয় ভাবে, কলমটা সে তার দুই ঠোঁটের কোণায় চেপে ধরলো। ভাবটা এমন, যেন সে সিগারেট মুখে নিচ্ছে। হ্যাঁ তাই, ইমন কলমটাকে বানিয়েছে একটা সিগারেট।

ইমন এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে আর নানান ভঙ্গিতে সদ্য কলম দিয়ে বানানো সেই সিগারেট খাচ্ছে। ধোয়া ছাড়ার অভিনয়টাও ভালোভাবেই করছে সে। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে আর সিগারেট টানতে টানতে, সে আড়চোখে আয়নার দিকে তাকালো। সোজা হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে, আবার মুচকি হাসলো। ইমন কিছুক্ষণ অব্দি নিজেকে আয়নায় ভালো করে দেখলো। বাম হাত দিয়ে চুল ঠিক করলো।সে এতসব কাজ করছে, কিন্তু সে তার বাঁ পায়ের উপর থেকে ডান পা'টা একটুর জন্যও নামাচ্ছে না।
এবার ইমন একটু নড়েচড়ে বসলো। সে তার কিছু প্রিয় সিনেমার সংলাপ, মনে মনে বাছাই করলো। প্রথমেই একটা সংলাপ তার মাথায় এলো। তবে তার শুধু এই সংলাপটাই প্রিয়। সিনেমাটা প্রিয় নয়৷

সংলাপ বলার পর্ব শুরু করার আগে, বেশ শব্দ করে একটা কাশি দিয়ে; ইমন কান পেতে রইলো। সে বোঝার চেষ্টা করছে তার বাবা'র ঘুমটা কতটুকু গভীর। খানিকক্ষণ পর বোঝা গেলো, বেশ ভালো গভীর ঘুমেই আছেন জনাব মোস্তাফিজুর রহমান ফারুকী সাহেব। 
ইমন আগের মতো আয়নার দিক তাকালো। গলার স্বর কিছুটা মোটা করতে, হালকা করে দু-একবার কেশে নিলো। কিছুক্ষণ সময় নিলো নিজেকে স্থির করার জন্য। তারপর হাত নাড়াতে নাড়াতে বলতে লাগলো-

“ রিশতে মে হাম তুমহারে বাপ লাগতে হ্যাঁয়।... নাম হ্যাঁয় শাহেনশাহ্... ''

ইমন তার নিজের অভিনয়ে, নিজেই অনেকটা মুগ্ধ হয়ে গেলো। ভিন্ন ভিন্ন সিনেমার আরও তিন চারটা সংলাপ, সে লাগাতার বলতে লাগলো। এরপর মুখে যা আসতে লাগলো, সে তাই বলতে লাগলো।
একসময় সে লক্ষ্য করলো, কয়েকটা ভাষা মিলিয়ে সে একটা খিচুড়ি ভাষা বানিয়ে ফেলেছে। একটু ইংরেজি, একটু বাংলা, একটু হিন্দি, আর একটু চাইনিজ। শুনতে বিশ্রী লাগলেও, ইমনের বেশ মজা লাগছে এই ‘খিচুড়ি’ ভাষা বলতে।

তবে খিচুড়ি ভাষা বলতে মজা লাগাটা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। ইমন আয়নার উপর থেকে চোখ সরিয়ে, মেঝের উপর রাখলো। দু'হাত দিয়ে পুরোপুরি চোখ-মুখ ঢেকে ফেললো। এরপর আলতো করে চোখ জোড়া ডলতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পর চোখ ডলা থামালো। তারপর দু'হাত দিয়ে চোখ-মুখ ঢেকে রাখলো। 

আজ ইমন এর জন্মদিন। উনত্রিশ থেকে ত্রিশ এ পা রাখতে চলেছে সে।বয়স ত্রিশ এ পা রাখাটা মোটেও কোন নীরস ব্যাপার নয়। খুব একটা বুড়োও নয় আবার খুব একটা অল্পবয়স্কও নয়, ব্যাপারটা কিছুটা এরকম। একটা নতুন দশক দশক ভাব। 
তো ব্যাপারটা নিশ্চয়ই কোন নীরস ব্যাপার নয়। বেশ মজারই বলা যায়। তবু এ ব্যাপারটি নিয়ে মাথা ঘামানো না কিংবা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করা, ইমন এসবের কিছুই করছে না। 

আজ তার জন্মদিন। বিশেষ একটা দিন। অথচ কিছুই আর আগের মতো নেই। সবই যেন বদলে গিয়েছে। কোনকিছুই যে বদলাবে না, এমনটা ইমন আশাও করেনি। সব কিছুই বদলায়। বদলাতে হয়। বদলানোটা অত্যন্ত প্রয়োজন। এটাও প্রকৃতির ধরাবাঁধা নিয়মগুলোর একটি। 
তবে তার মনে হচ্ছে সবই কেমন যেন একটু বেশিই বদলে গিয়েছে। এমনটা সে আশা করেছিল না। এমনটা হওয়ার কথাও ছিল না। তাই ইমন অন্তত আজকের দিনটার জন্য হলেও, সবকিছু আগের মতো করার চেষ্টা করছে। সে জানে সে পুরোপুরি পারবে না। তবু করতে মানা কী? চেষ্টা করে দেখাই যাক না একবার। 
গতবছরও জন্মদিনের রাতটা সে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছিলো। ভালোই কাটিয়েছিলো। তখন তার সাথে মিতু ছিল। আজ মিতু নেই। তবে রাত জাগাটা আছে। পুরোপুরি না হলেও কিছু অংশ আগের মতো করা গেলো। 

মসজিদগুলোতে ফজরের আযান দেয়া শুরু করেছে। ইমন বিছানার দিকে এগোচ্ছে। কিছুটা ক্লান্ত লাগছে। বিছানায় গা ছেড়ে দেয়া মাত্রই, চোখ জোড়া বন্ধ হয়ে এলো এবং সেই সাথে চাপা পরে গেলো রাজ্যের কষ্টগুলোও। 


ময়ূরাক্ষী আমারও - হাসান পিয়াস  

২.

দুপুর হয়ে গিয়েছে। দেড়টা বাজছে। 
ইমনের ঘুম ভাঙলো মিতু'র গলার আওয়াজে। আওয়াজটা অনেকটা অস্পষ্ট। ঘুম পুরোপুরি ভাঙেনি। চোখ জোড়া ভারী হয়েই আছে। মেলানো যাচ্ছে না। মিতু'র গলার আওয়াজ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগলো। ইমন শুনতে পেলো, মিতু তাকে ডাকছে।
''এ্যাই৷....এ্যাই, ওঠো...এ্যাই...!'' 

একবার-দুবার ডাকছে না। লাগাতার ডাকছে। 
মিতু ক্রমশ রেগে যাচ্ছে। বলছে ''উঠবি তুই?! নাকি আসতে হবে আমার''।
কথাটা বলতে বলতে সে ইমনের রুমে চলে এলো।ইমনের পিঠে ঝাকুনি দিয়ে; আবার বললো, ''এ্যাই...এ্যাই, ওঠো...!''
ইমন আধোঘুমেই বললো, তুমি কখন এলে?

- মাত্রই এলাম। 
- বাবা কই?
- বাহিরে গিয়েছেন একটু।
- কই গিয়েছেন? 
- সোবহান চাচা হঠাৎ একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সেখানেই গিয়েছেন। তুমি রেগে যাবে, এজন্য বাবা যেতে চাইলেন না। কিন্তু সোবহান চাচা'র বয়স তো কম হলো না, কখন কী হয়ে হয়ে যায় বলা মুশকিল____এজন্য আমিই জোর করে পাঠিয়েছি।
ইমন চাপাস্বরে বললো, ভালো করেছ। 
- রাগ করলে না?
- না।
- একদমই না?
- না। 

ইমন চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসলো। একপ্রকার ঘোর অনুভব করছে সে। প্রশ্নসূচক স্বরে বললো, “তোমার না এখন নারায়ণগঞ্জ থাকার কথা! মা'র কাছে যাওনি....”
মিতু প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো। ভ্রু কুঁচকে বললো, ব্লেজার পরে শুয়েছিলে নাকি?
হতভম্ব চোখে ইমন তার গায়ের ব্লেজারের দিকে তাকালো। বেশ ভালো রকমের লজ্জা পেয়েছে সে। লজ্জা মাখা হাসি দিয়ে বললো- “ওই আরকি.....কখন কীভাবে, পরে শুয়ে পড়েছি, নিজেই ভুলে গেছি।”
- হু বুঝেছি। 
- কী বুঝেছ?
- যা বোঝার তাই বুঝেছি। 
- তুমি কী বুঝলে, আমি সেটা বুঝছি না।
- উফ্, হয়েছে। থামো এবার।....আর মিথ্যে বলাটাও থামিও। 
কী একটা ভেবে ইমন কাচুমাচু হয়ে গিয়ে বললো, “আচ্ছা।”

মিতু'র ভ্রু জোড়া মসৃণ হয়ে এলো। বললো, “ফ্রেশ হয়ে নাও।” কথাটা বলে সে একটুখানি থামলো। মৃদু হেসে,“দুপুরই তো হয়ে গিয়েছে, গোসল করে ফেলো।....গোসল করে এসো, আমি পায়েস রান্না করছি।” বলে মিতু চলে গেল।

এক ধরনের আরামদায়ক আলস্যে ইমনের মন ভরে এলো। অকারণেই। শীতকাল চলছে৷ শীতকালের আবহাওয়ায় এমনিতেই একটা আলস্য লেগে থাকে। ইমন কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পরই আবার ঘুমে তলিয়ে গেলো সে। 
মিতু মৃদু কণ্ঠে গান গাচ্ছে আর গানের তালে তালে পায়েস রান্না করছে। সে ভাবছে, ইমন গোসল করতে গিয়েছে।

ইমন এর প্রিয় খাবারের শেষ নেই, তার অনেক কিছুই প্রিয়। তাই মিতু ইমন এর খুব প্রিয় খাবারগুলোর মধ্য থেকে “খুব,খুব” প্রিয় খাবারগুলো বাছাই করে, একটা লিস্ট করে রেখেছে। কই মাছ ভাজা, আলু ছোট ছোট করে কেটে নারিকেল বাটা দিয়ে ঘুষো চিংড়ি'র তরকারি, গরুর কলিজা ভুনা, বেশি ঝাল করে খাসির মাংস, খিচুড়ি আর পায়েস। “মিতু'র হাতের পায়েস”। মিতু'র হাতের পায়েস ইমন এর খুব পছন্দ। খুব।

ইমন এর ঘুম খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। আধাঘণ্টার মধ্যেই ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুম ভাঙা মাত্রই, সে উঠে বাথরুমের দিকে দৌড় দিলো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা সেই চেয়ারটার সাথে ধাক্কা খেয়ে ইমন ধাম করে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। বেশ ভালো মাপের শব্দ হলো। মিতু চিৎকার দিয়ে উঠে, বললো, কী হলো আবার....কী পড়লো, এ্যাই!...এ্যাই...


৩.

দেড় ঘণ্টা হয়ে এলো ইমন বাথরুমে আছে। ইমনের কাছে সময়টা দেড় ঘণ্টা হলেও, মিতু'র কাছে সেটা দু'ঘণ্টা। তবে এটা কোন অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়৷ পুরোটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। ইমন বাথরুমে একবার ঢুকে গেলে, ঘণ্টাখানেক না কাটানো অব্দি সেখান থেকে বের হয় না।

ইমন তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে খাবারের টেবিল এর সামনে এসে দাঁড়ালো। টেবিল ভর্তি নিজের প্রিয় খাবারগুলো দেখে, ইমন মৃদু হাসলো।
মিতুকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ইমন মিতুকে ডাক দিতে যাবে, ঠিক তখনই পেছন থেকে মিতু বলে উঠলো, “হ্যাপি বার্থডে, মি. রাক্ষস!”

ইমন চমকালো না। স্বাভাবিকভাবে পেছনে ঘুরে, ঠোঁট নেড়ে বললো, “থ্যাংক য়্যু...।”, কোন আওয়াজ হলো না। তারপর বললো, আচ্ছা, একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো, তুমি আমাকে রাক্ষস বলে ডাকো কেন?....জানতে ইচ্ছা করছে। যদিও সেই ছয় বছর ধরেই ডাকছো। তবে আজ কারণটা জেনে নেওয়া উচিত। উচিত বলতে, জানতে খুব ইচ্ছে করছে আরকি।

মিতু কেন ইমনকে রাক্ষস বলে ডাকে, সেটার কারণ মিতু'র জানা নেই৷ মিতু ভাবছে কী কারণ দেয়া যায়। উত্তর দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ার জন্য মিতু খানিকক্ষণ সময় নিলো। তারপর বললো, “কেন বলি, সেটা জানি না। বলতে ভালো লাগে, এজন্যই হয়তো বলি।”

“তাই?”, ইমন হাসছে। সাথে তার চোখজোড়াও হাসছে। 

“হ্যাঁ তাই।....সত্যিই জানি না, কেন বলি।” 

“আচ্ছা থাক বাদ দাও। কারণ খোঁজার দরকার নেই। তোমার আমাকে রাক্ষস বলতে ভালো লাগে; আর আমার, তোমার মুখ থেকে রাক্ষস শুনতে ভালো লাগে। কিছু জিনিস অকারণেই হোক।”

“হ্যাঁ।” 

“হ্যাঁ।”

“হুঁ।”

“....হুঁ।”

“জ্বি।”

“....জ্বি।”

মিতু বললো,“উঁহু, থামবে তুমি!....আর পারবোনা কন্টিনিউ করতে। পারবও না কোনদিন তোমার সাথে।” 

ইমনও বললো,“উঁহু, থামবে তুমি!....আর পারবোনা কন্টিনিউ করতে। পারবও না কোনদিন তোমার সাথে।” 

মিতু আহত চোখে তাকিয়ে আছে। ইমন এর বড়ো মায়া লাগছে সেই আহত চোখজোড়া দেখে। ভালোবাসা জড়ানো মায়া। ইমন মনে মনে বললো, “তুমি এত সুন্দর কেন? এর কোন বিশেষ কারণ কী আদৌ আছে? নাকি এটাও অকারণেই?”

মিতু তার আহত চোখজোড়া স্বাভাবিক করে বললো, “তাকিয়ে আছো কেন এভাবে?”

ইমন মৃদু হাসলো। বললো, “চলো খেতে বসি। একসাথে বসে খাওয়া হয় না অনেকদিন।”

“অনেকদিন কীভাবে হলো? দু'দিন আগেই তো খেলাম একসাথে।”

“খেয়েছিলাম নাকি? মনে নেই...।” ইমন বললো, “দু'দিন আগে খেয়ে থাকলে খেয়েছি, কিন্তু আজ খাবো স্পেশাল ভাবে। সবচে বড় কই মাছটা তুমি আমাকে দিতে চাইবে। আমি নিতে চাইবো না। তবু তুমি জোড় করেই আমার পাতে রাখবে। আবার, আমি সেটা তুলে দিবো তোমার পাতে। তুমি হার মেনে নিয়ে, আমার দিকে আহত চোখে তাকিয়ে থাকবে। মুখে একটা মৃদু হাসি বসিয়ে, আমিও তোমার দিকে তাকিয়ে থাকবো। তারপর তুমি হেসে ফেলবে।....তবে চিংড়ি'র বেলায় ব্যাপারটা ঘটবে ভিন্ন। বড় চিংড়িগুলো আমার পাতেই থাকবে, হিহি....। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতিচারণ করবো। নাহ্, স্মৃতিচারণ করার ফাঁকে ফাঁকে খাবো।”

মিতু খানিকটা শব্দ করে হাসলো। সে হাসিতে রাজ্যের আনন্দ। রাজ্যের ভালোলাগা। হাসতে হাসতেই মিতু বললো, “....তোমার দেখছি ফ্যান্টাসি'র অভাব নেই।”

ইমন মিতু'র দিকে এগিয়ে; ডান হাত দিয়ে আলতো করে মিতু'র নাক চেপে ধরে দোলাতে দোলাতে বললো, “বুঝলেন ম্যাডাম, ‘সবার উপর ফ্যান্টাসি সত্য, তাহার উপর নাই’।”
“সবার উপর ফ্যান্টাসি সত্য, তাহার উপর নাই”
“সবার উপর ফ্যান্টাসি সত্য, তাহার উপর নাই”, ইমন ক্রমাগত এভাবে বলেই যাচ্ছে। 
নিমিষেই টেবিলে রাখা খাবার গুলোর সাথ সাথে মিতু'ও হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। দেয়ালের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে ইমন বসে আছে খাঁটের উপর। “সবার উপর ফ্যান্টাসি সত্য, তাহার উপর নাই” কথাটা বলা থামিয়ে, ইমন চোখ বুজলো। ইমন মিতুকে এখন নিয়ে যাবে হিমু'র সেই ময়ূরাক্ষী নদীতে। 
হিমু'র সেই মময়ূরাক্ষী নদী, হিমু'র ব্যাক্তিগত জিনিস। সবাইকে সেটা ব্যবহার করতে দেন না হিমু। তবে ইমনের বিশ্বাস, তার হিমু ভাই তাকে তাঁর ময়ূরাক্ষী নদী ব্যবহার করতে দিতো। ভালোবেসেই দিতো। 

ময়ূরাক্ষী ছোট্ট একটা নদী। তার পানি কাঁচের মত স্বচ্ছ। নিচের বালিগুলো পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যায়। নদীর দুইধারে দূর্বাঘাসগুলো সবুজ! কোমল! নদীর ঐ পাড়ে বিশাল ছায়াময় একটা পাকুড় গাছ। সেই গাছে বিষণ্ণ গলায় একটা ঘুঘু ডাকে। সেই ডাকে একধরনের কান্না মিশে আছে।
ইমন হিমু-ভক্ত লোক। কিন্তু তার কোন হলুদ পাঞ্জাবী নেই। তবে কল্পনার জগতে হলুদ পাঞ্জাবী আনতে আর কতক্ষণই লাগে। ইমন পরলো হলুদ পাঞ্জাবী, মিতু পরলো নীল শাড়ি। নদীর পানিতে পা ডুবিয়ে দুজন বসে আছে। ইমন বাচ্চাদের মতো করে কান পেতে ঘুঘুর ডাক শুনছে, তার এই অবস্থা দেখে মিতু হাসছে। একসময় ইমনও হেসে ফেললো। 

ইমন চোখ খুললো। গরম লাগছে, ব্লেজার খুলে ফেললো। পানি খেতে মন চাচ্ছে। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে, উঠতে পারলো না। সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। চিৎ হয়ে হয়ে শুয়ে পড়লো। শরীর কাঁপছে। কাঁপুনি ক্রমশ বাড়ছে। কাঁপা গলায় ইমন তার মা'কে ডাকলো, “মা___আছো?”। মা এলেন না। সে আবার ডাকলো, “মা___আছো?”। মা এবারো এলেন না। আসবেনও না। ইমনের মা বেঁচে নেই। ডাক শুনে ইমনের বাবা দৌড়ে ইমনের রুমে এলেন। দরজার কাছে এসে, থমকে দাঁড়ালেন। ফারুকী সাহেবের বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো, কী হচ্ছে এখন। তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে, ইমনের পাশে গিয়ে বসলেন। ইমন দিশেহারা ভঙ্গিতে চারদিক তাকাচ্ছে। শুধু তার বাবার দিকে তাকাচ্ছে না। ফারুকী সাহেব ইমনের বাঁ হাত চেপে ধরলেন। হাত চেপে ধরা মাত্রই, ইমন শব্দ করে গোঙানি দিয়ে উঠলো। ফারুকী সাহেব ইমন এর দিক থেকে মুখ সরিয়ে, জানালার দিকে তাকালেন। 

ইমন এর লাং ক্যান্সার ধরা পড়েছে, চার মাস হলো। ফোর্থ স্টেজ। ইমন পাঁচ বছর থাকাকালে তার মা মারা যায়। ছেলেকে একাই বড় করেছেন। লোকে কতবার বিয়ে করার পরামর্শ দিয়েছে। ফারুকী সাহেব শান্ত গলায় তাদের জবাব দিয়েছেন, “নাহ্”। জানালা থেকে চোখ সরিয়ে, ফারুকী সাহেব দেয়ালে ঝোলানো ইমন এর মায়ের ছবিটার দিকে তাকালেন। হঠাৎ ঘুঘুর ডাক শোনা গেল। ঢাকা শহরে ভরদুপুরে ঘুঘুর ডাক শোনা যাওয়া ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও, ফারুকী সাহেবের সেদিকে খেয়াল নেই। ইমন এর গোঙানির আওয়াজ ক্রমশ বাড়ছে। গোঙানির আওয়াজের সাথে, ঘুঘুর বিষন্ন ডাক মিশ্রিত হয়েছে। ফারুকী সাহেবের চোয়াল ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছে। ইমনের মায়ের ছবি থেকে ফারুকী সাহেব চোখ সরাচ্ছেন না। তার চোখজোড়া ভিজে আসছে। সেই ভেজা চোখজোড়া মৃত এক ব্যাক্তির ছবির কাছে প্রশ্ন করছে, আমাকে কেন একা ফেলে গেলে?
____



1 মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন